একুশে পদক
এতদিন মনে হতো মানুষের ভালোবাসা আছে কিন্তু ঝোলাটা খালি: ফেরদৌস আরা

সংগীতে বিশেষ অবদানস্বরূপ একুশে পদক ২০২৪ পাচ্ছেন জনপ্রিয় নজরুল সংগীতশিল্পী ফেরদৌস আরা। সুসংবাদটি ছড়িয়ে পড়তেই উত্তরের কণ্ঠের কাছে মনের আগল খোলেন নন্দিত এই কণ্ঠশিল্পী।
একুশে পদক পাচ্ছেন। খবরটি শুনে কেমন লাগছে?
এরকম খবর পেলে সবারই ভালো লাগে। আমিও তাদের থেকে ব্যতিক্রম নই। এমন অবস্থায় সবাই বলেন দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। অবশ্যই বেড়ে যায়। করণীয়ও অনেক কিছু থাকে। যেগুলো নিয়ে এতকাল শুধু ভেবেছি। করতে পারব কিনা জানতাম না। এখন আত্মবিশ্বাস, সাহস বেড়ে গেছে।
আগে থেকে আঁচ পেয়েছিলেন?
কিছু দিন ধরে শুনছিলাম। এ খবর দিত। ও খবর দিত। পরে আবার বলত, ‘আপা হবে না, লোক বদলে গেছে।’ আবার কেউ বলত, ‘আপনার তো পাওয়া উচিত ছিল।’ এরকম কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে। দেখতে দেখতে বিশ্বাস এতই কমে গিয়েছিল যে ভাবতাম, শুনব-ই শুধু ভাগ্যে আর জুটবে না। অথচ এমন দিনে সংবাদটি এলো— আজ আমার বরের জন্মদিন। আমার মেয়ে এসেছে কানাডা থেকে। এই যে সংযোগ এটা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা। আমার ছেলে ফোন করে বলছে, ‘মা তুমি কখন বাসায় আসবে।’
প্রথম কার থেকে শুনতে পেলেন?
সাংবাদিক যাযাবর মিন্টু প্রথমে ফোন করে বলল, ‘আপা একটা প্রতিক্রিয়া জানান।’ বললাম, ‘কীসের!’ আমি তখনও জানি না। তবে বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা হচ্ছে। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরেই এরকম শুনি। তাই আমলে নিচ্ছিলাম না। কিন্তু যখন জানতে চাইলাম কীসের রিয়্যাকশন দেব তখন বলল, ‘আপনি তো একুশে পদক পাচ্ছেন।’ কিন্তু বিশ্বাস তো নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বললাম, ‘দাঁড়াও আসলেই পেয়েছি কি না দেখি। নাকি তুমি কি কারও থেকে শুনে বলছ?’ সে বলল, ‘না, আসলেই।’ এরমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে গুণী বাঁশিবাদক আজিজুল হক ফোন দিলেন। উনি বললেন,‘আপনাকে কংগ্রাচুলেশনস।’ বললাম, ‘আমাকে একজন বলেছে কিন্তু আমি নিশ্চিত নই।’ উনি তখন বললেন, ‘আপনি নিশ্চিত থাকুন।’ তার মুখেই প্রথম শুনি।
শুনে প্রথম কার কথা মনে পড়েছিল?
ছেলে-মেয়ে, স্বামী, পরিবারের কথা। গানের ক্ষেত্রে প্রতিমুহূর্তে সহায়তা করেছেন আমার বাবা। যত্ন পেয়েছি মায়ের থেকে। প্রথমে বাবার চেহারাটা ভেসে উঠেছে, মায়ের যত্নের কথা মনে পড়েছে। আমার স্বামী সঙ্গেই ছিলেন।
মায়ের এই প্রাপ্তিলাভের সংবাদে সন্তানদের অনুভূতি কী?
আমার ছেলেকে ওর বন্ধুবান্ধব বলত, ‘তোমার মা এত জনপ্রিয় কিন্তু অ্যাওয়ার্ড পাননি। ওনার তো পাওয়ার কথা ছিল।’ ওর চোখ ছলছল করে উঠত। ও আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলত, ‘মা তুমি অনেক ইয়ং। তোমার এখনও সময় আছে। মেয়ে বলত, ‘তুমি পাবেই পাবে।’ অনেক সময় চোখ ছলছল করে ওর দিকে তাকিয়ে বলতাম, মাগো, তোমাদের আশা যেন এভাবেই থাকে। না পেলেও ভেঙো না।’
রাষ্ট্রীয় সম্মাননাকে অনেকে পূর্ণতালাভের সঙ্গে তুলনা করেন। আপনি কীভাবে দেখেন?
যখন থেকে গান শুরু করেছি তখন থেকে আজ পর্যন্ত সকল শ্রেণির মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি। যখন দেখি কেউ বলেন আমার মা, কেউ বলেন স্ত্রী, কেউ বলেন দাদি আপনার গান পছন্দ করেন, নতুন প্রজন্মের অনেকে প্রণাম করে বলে, আমি আপনার ফ্যান— তখন মনে হয় এটাই বোধহয় বড় প্রাপ্তি। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে একটু হলেও ধরতে পেরেছি। ওরা যেভাবে আমাকে সম্মান করে সেটা অনেক বড় পাওয়া। একটি ঘটনা বলি। ত্রিশালের দরিরামপুরের ঘটনা। এখনও মনে আছে ওখানকার ডিসি একবার পাগলের মতো আমার বাসায় ছুটে এসেছিলেন। বলছিলেন, ‘আমি এত রাতে আপনার বাসায় এসেছি। আমাকে বাঁচান।’ আমি বললাম, ‘মানে কী!’ তিনি বললেন, ‘লোকজন আমাকে এসে বলছে, তিন দিনের প্রোগ্রামে একদিন শুধু ফেরদৌস আরার গান রাখতে হবে। নইলে আপনার প্যান্ডেল ভেঙে দেব।’ আমি উনাকে বললাম, ‘অবশ্যই যাব।’ গিয়ে দেখলাম নিরাপত্তার জন্য তিন সারি করে র্যাব দাঁড়ানো। গ্রামের বৃদ্ধ নারীরা কান্নাকাটি করছেন। এত রাতে কিন্তু গ্রামের নারীরা গান-বাজনা শুনতে বের হন না। অনেকে আমার দিকে ছুটে আসছিলেন। র্যাবের সদস্যরা বাধা দিচ্ছিলেন আর আমাকে বলছিলেন, ‘আপা তাড়াতাড়ি দোতালায় উঠুন। মানুষের ঢল ছুটলে চ্যাপ্টা হয়ে যাবেন।’ দেখলাম, সবাই আমার দিকে ছুটে আসছেন। দৌড়ে কোনোরকম ওপরের তলায় উঠলাম। দৌলতপুর নার্গিস আসার খানমের বাড়ি। সেখানেও এরকম ঘটনা ঘটেছিল। তারপর থেকে মনে হতো, মানুষের ভালোবাসা আছে কিন্তু আমার ঝোলাটা খালি। আর পুরস্কার লাভের পর মনে হয় সাধারণ মানুষের ওই ভালোবাসা হাজার কোটি টাকা দিয়েও জোগাড় করা সম্ভব না।
আপনি পাচ্ছেন শুনে বলছে, সঠিক মানুষের হাতে যাচ্ছে পদক। এর আগে অনুপযুক্তদের হাতে একুশে পদক যাওয়ার অভিযোগ একাধিকবার উঠেছে। এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
একেকজনের ক্ষেত্রে একেকটা হয়। কারও ক্ষেত্রে অনেক দিনের চাওয়া থাকে। তিনি পেলে সবাই বলে সঠিক মানুষটি পেল। আবার কেউ মানুষের চাওয়ায় তৈরি হওয়ার আগেই পেয়ে গেছেন। সেক্ষেত্রে ওইসব কথা আসে।
আপনার মতামত লিখুন