দুই হাত নেই রহিমের, পাশে দাঁড়ালেন নারায়ণগঞ্জের ডিসি

সোমবার (৩ মার্চ) দুপুর সাড়ে ১২টা। নারায়ণগঞ্জে মাসব্যাপী গাছ সুরক্ষা (গাছ থেকে পেরেক তোলা) কর্মসূচির উদ্বোধন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা।
তার সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিলুফা ইয়াসমিন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন) মো. আব্দুল ওয়ারেছ আনসারি, ঢাকা সমাজিক বন বিভাগ ও ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহমুদা রোকসানা সুলতানা, সহকারী কাজী মাহিনুর রহমান, জান্নাতুল ফেরদৌস, ভারপ্রাপ্ত উপজেলা বন কর্মকর্তা মো. আবু মুন্না প্রমুখ।
রোভার স্কাউটস ও বিডি ক্লিন নারায়ণগঞ্জের সদস্যরাও জেলা প্রশাসকের পেছনে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করে হাজির অপরিচ্ছন্ন পোশাকে এক যুবক। জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে কিছু বলার জন্য তার সামনে চলে আসছেন দেখেই জেলা প্রশাসকের সাথে থাকা নিরাপত্তা কর্মীরা বাধা দিলেন। কিন্তু সারা দেশে মানবিক জেলা প্রশাসক হিসেবে পরিচিত জাহিদুল ইসলাম দূর থেকে খেয়াল করলেন যুবকের দুই হাত নেই। তাই তিনি নিজে এগিয়ে গেলেন যুবকের কাছে।
যুবককে নিজে থেকে সালাম দিলেন ও নিজের পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন করলেন, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? তার আচরণ দেখে কিছুটা হতভাগ উপস্থিত সবাই। সংক্ষেপে যুবকের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনে পরদিন তাকে অফিসে আসতে বললেন তিনি। জেলা প্রশাসক তার সঙ্গ থাকা স্টাফকে যুবকের বিস্তারিত নাম ও পরিচয় লিখে নিতে বললেন। নির্দেশ দিলেন স্থানীয়ভাবে যুবকের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করতে। যাচাই-বাছাই করে জানা যায় যুবকের নাম আব্দুর রাহিম। বয়স ২২ বছর। ফতুল্লা থানার উত্তর নরসিংপুর এলাকার বাসিন্দা মরহুম আজিজুল বেপরীর ছেলে এই রহিম।
রহিমের মা রেহেনা পারভিন জানান, রহিমকে মাদরাসায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পড়াশোনায় মনোযোগী না হওয়ায় ২০১৫ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সেই তার বাবা তাকে স্থানীয় একটি হোসিয়ারি কারখানায় অস্থায়ী শ্রমিকের কাজ দেয় সংসারের অভাব অনটন দূর করতে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কাজে যোগ দেওয়ার মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যেই খবর আসে হাই ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক তারে হাত লেগে সারা শরীর দগ্ধ হয়েছে রহিমের। দ্রুত নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। কিন্তু ডাক্তারদের অনেক চেষ্টার পরেও জীবন বাঁচাতে রহিমের দুই হাতই কেটে ফেলতে হয়। পরিবারের বোঝা হয়েই থাকতে হয় তাকে। বয়স বাড়তে থাকায় ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার মা রহিমা বেগম দরিদ্র ঘরের মেয়ে পপি আক্তারের সাথে বিয়ে দেন রহিমকে। তাদের ঘরে তিন বছর বয়সী সন্তান মোতাকাব্বির। দুই হাত না থাকায় মানুষের কাছে সাহায্য নিয়েই চলে রহিম-পপির সংসার।
গৃহবধূ পপি বলেন, রোজা শুরু হয়েছে। ঘরে বাজার নেই। বাসা ভাড়াও বকেয়া কয়েক মাসের। বাড়ির মালিক বাসা ছেড়ে দেওয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই আমার স্বামী গতকাল সোমবার ডিসি স্যারের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। ডিসি স্যার একদিনের মধ্যেই তার অফিসে ডেকে নিয়ে আজ মঙ্গলবার (৪ মার্চ) ১০ হাজার টাকার চেক দেন। সাথে ব্যাক্তিগতভাবেও নগদ দুই হাজার টাকা দেন আমার শিশু সন্তানের ঈদের পোশাক কেনার জন্য।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে চেক গ্রহণকালে কান্নায় ভেঙে পড়েন রহিম। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, অভাবের কারণে সংসারে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। আমি এভাবে সাহায্য নিয়ে বাঁচতে চাই না। আমাকে সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিরা যদি একটা ছোট দোকান করে দিত, তাহলে আমার স্বপ্ন আমার ছেলেটাকে পড়াশোনা করাতে পারতাম।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম বলেন, সরকারী তহবিলের সীমাবদ্ধতার কারণে আমি চাইলেও শারীরিক প্রতিবন্ধী রহিমকে খুব বেশি আর্থিক সাহায্য করতে পারিনি। তবে আমি পরিকল্পনা করছি কীভাবে তাকে আর্থিকভাবে পুনর্বাসন করা যায়। যাতে তার স্বপ্ন একমাত্র সন্তানকে পড়াশোনা করানোর ব্যবস্থা করতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন