দ্বিতীয় সচিব আরজিনার সম্পদের পাহাড়, গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীতে


-
অবৈধ অর্থে ৫০০ ভড়ি স্বর্ণ কিনেছেন আরজিনা।
-
রাজধানী ঢাকার মিরপুরে একটি ফ্লাট কিনেছেন ২ কোটি টাকায়।
-
গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলায় ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মান করেছেন আলিসান বাড়ি।
ছাগলকাণ্ডের আলোচিত মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরাই যে কেবল অঢেল সম্পদ গড়েছেন তা নয়, বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে গেছেন সাবেক এই রাজস্ব কর্মকর্তার বান্ধবী আরজিনা খাতুন।
এই আরজিনাও এনবিআরের কর্মকর্তা। রাজস্ব বোর্ডের মূসক মনিটরিং, পরিসংখ্যান ও সমন্বয়ের দ্বিতীয় সচিব। এর আগে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের উপ-কমিশনার ছিলেন।
মতিউরের মতোই অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে আরজিনার বিরুদ্ধে। মতিউরের সাথে সর্ম্পক রেখে তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার তালুকপাড়া গ্রামের আহমেদ আলীর মেয়ে আরজিনা খাতুন।
দ্বিতীয় সচিব হিসেবে আরজিনা খাতুন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে থাকার সময় কোটি কোটি টাকা অবৈধ্যভাবে আয় করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই টাকায় তিনি ঢাকা ও রাজবাড়ীতে কিনেছেন স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি।
গত ১০ জুন আরজিনার দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের খতিয়ান তুলে ধরে দুদকে অভিযোগ জমা দেন আরজিনার সাবেক স্বামীর বন্ধু ইসতিয়াক আহমেদ রেজা।
দুর্নীতি দমন কমিশনে আরজিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে ফিরিস্তি জমা পড়েছে, তা বেশ লম্বা। রাজধানীতে ফ্ল্যাট, গ্রামে আলিশান বাড়ি, পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে জমি, বাসায় বিলাসবহুল ইন্টেরিয়র এবং দামি সব আসবাবপত্র করেছেন।
ছাগলকাণ্ডে ফেঁসে যাওয়া মতিউর রহমানের সাথে সখ্য ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। এনিয়ে এলাকায় চলছে নানা আলোচনা সমলোচনা।
দুদকে দাখিলকৃত অভিযোগে বলা হয়েছে, আমদানি পণ্য খালাসের নামে একশ্রেণির ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের থেকে হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। অনেক সময় পণ্য খালাসের কাজ না হলেও ফেরত দিতেন না ঘুষের টাকা। এভাবে দুর্নীতির টাকায় তিনি গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। একই সঙ্গে স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশে হাতিয়েছেন প্রায় ৬ কোটি টাকার স্বর্ণ।
মাত্র তিন বছরে ৫০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কারের মালিক এই আরজিনা। এর মধ্যে ২০০ ভরিই চোরাচালানের মাধ্যমে আনা হয়েছে বলে দুদকের কাছে অভিযোগ জমা পড়েছে।
সম্প্রতি দুর্নীতি, অনিয়মের নানা অভিযোগ মাথায় নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে আলোচিত কর্মকর্তা মতিউর। তবে আরজিনার সঙ্গে তার একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়ে প্রকাশ্যে চলে এসেছে। সেই ফোনালাপ থেকেই ছাগলকাণ্ডের মতিউরের সঙ্গে তার অধস্তন আরজিনা খাতুনের সম্পর্ক নিয়ে অনেক অজানা তথ্য সামনে এসে পড়েছে।
আরজিনা খাতুন আগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার ছিলেন। এক বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বদলি করা হয় তাকে। চট্টগ্রামে থাকাকালীন তার ঘুষের টাকা লেনদেনের বাহক ছিলেন তার বন্ধু আবু তাহের, অফিসের পিয়ন মো. ইলিয়াস ও গাড়িচালক শাহাজাহান আকতার।
তার বিরুদ্ধে দুদকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, অবৈধভাবে উপার্জন করা অর্থে ৫০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন আরজিনা খাতুন। তার বার্ষিক আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন, বিয়ের সময় ১০০ ভরি স্বর্ণ উপহার পেয়েছেন। কিন্তু তার বিয়ের কাবিননামায় এসব স্বর্ণের কথা উল্লেখ নেই।
অভিযোগে আরও বলা হয়, আরজিনা ১০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন রয়েল ঢাকার মালাবার দোকান থেকে। বাকি ৩০০ ভরি কিনেছেন ঢাকার আপন জুয়েলার্স ও ডায়মন্ড ওয়াল্ড দোকান থেকে। বর্তমানে এসব স্বর্ণের মূল্য অন্তত ৬ কোটি টাকা। দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের লকার ও দোকানে স্বর্ণগুলো বন্ধক রেখেছেন তিনি।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ক্রয়মূল্য গোপন করে ঢাকার মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে দ্বিতীয় সচিব আরজিনা খাতুন। ফ্ল্যাটটি কিনেছেন ২ কোটি টাকায়। কিন্তু কেনার চুক্তিনামায় উল্লেখ করেছেন ১ কোটি ২১ লাখ টাকা। এছাড়া ফ্ল্যাট কেনার পর সেখানে ইনটেরিয়র ডিজাইনের পেছনে খরচ করেছেন ২৭ লাখ টাকা, ফ্ল্যাটের ইলেকট্রনিক ও ফার্নিচারের পেছনে ব্যয় করেছেন ৩৫ লাখ টাকা। তবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও তা ফ্ল্যাট কেনার এক বছর পর।
এছাড়া আরজিনার নিজস্ব একটি প্রাইভেটকার রয়েছে। ওই কারটি নিজের অর্থ দিয়ে কেনা হলেও সেটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান ‘আনবি লজিস্টিক লিমিটেডের নামে রেজিস্ট্রেশন করেন। ওই সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীও কাস্টমস কর্মকর্তার সঙ্গে দুর্নীতিতে জড়িত বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
দুদকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, কাস্টমসের চাকরির আগে আরজিনা খাতুনের বাড়ি ছিল ২০ ফুটের একটি টিনের ঘর। সম্প্রতি তার গ্রামের বাড়িতে ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন আলিসান বাড়ি। ফার্নিচার ও ইলেকট্রনিক খাতে ব্যয় করা হয়েছে আরও অন্তত ৩৫ লাখ টাকা।
অভিযোগে বলা হয়, সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা আরজিনা খাতুনের গ্রামের বাড়ির বাল্যবন্ধু হিসেবে সবার কাছে পরিচিত মো. আবু তাহের। তিনি এয়ারপোর্ট সংলগ্ন কাওলায় ব্যবসা করেন। আরজিনা চট্টগ্রাম কাস্টমসে থাকাকালীন পিয়ন ইলিয়াস ও তার গাড়িচালক শাহজাহান আকতারকে দিয়ে টাকা পাঠাতেন দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। একটি নিরো এন্টারপ্রাইজ, অপরটি বেঙ্গল ট্রেডিংয়ের নামে। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডে অ্যাকাউন্টগুলো রয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, আরজিনা তার বাবা আলী আহমেদের কাছে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি এলাকায় সোনালী ব্যাংক এবং মা-বাবার বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠাতেন। শুধু তা-ই নয়, ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তার আপন দুই ছোট ভাইয়ের নামে ৪০ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন আরজিনা। বর্তমানে সেখান থেকে ৩০ বিঘা জমি বন্ধক রাখা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় অভিযোগে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আরজিনার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের তালুকপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেই টিনের ঘরটি এখন আর নেই। সেখানে আলিসান বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। তার বাড়িতে গেলেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
তালুকপাড়া গ্রামের বেশ কয়েকজন বলেন, আহমেদ আলী একজন দিনমজুর। মাছ শিকার ও চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে তার। দুই ছেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। আর মেয়ে আরজিনা খাতুন অল্প দিনেই অনেক সম্পদ গড়ে তুলেছেন। নারুয়া বাজারে জমি ক্রয় করে ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। বালিয়াকান্দি ও রাজবাড়ী শহরে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। মাঠে ১০-১২ পাখি (১ পাখি=২২ শতাংশ) জমি ক্রয় করেছেন। ব্যাংকে টাকা আছে কি না বলতে পারব না। তবে তিন ছেলেমেয়ে চাকরি করার পর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আর্থিক অবস্থা পাল্টে গেছে।
নারুয়া বাজারে জমি ক্রয় করে ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন আরজু নামের এক ব্যবসায়ীর নিকট। তিনি বলেন, আরজিনা খাতুনের ভাই মতিন ও মেহের দুজন সেনাবাহিনীতে চাকরী করে। মতিন মিশনে যাওয়ার পর দেশে এসে বাজারের জমি ক্রয় করে টিনের ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে। তবে এটা আরজিনার কি না বলতে পারব না। তার বাবা জানান, ঢাকার ফ্ল্যাট ব্যাংক লোন নিয়ে কেনা। তবে অভিযোগ সত্য হলে মেয়ের বিচার চেয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে আরজিনা খাতুন মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমি দুদকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা অনেক বিচক্ষণ। তারা সবকিছু খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। আমি যদি অন্যায় করে থাকি তাহলে শাস্তি পাব।’ সব অভিযোগ মিথ্যা ও কাল্পনিক দাবি করে তিনি বলেন, ডিভোর্সের পর তার স্বামী আবু হেনা মো. রউফউল আজম এসব মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছেন। আরজিনা বলেন, ‘আমি এখন চরম অশান্তির মধ্যে রয়েছি। তবে দুদক ডাকলে তার জবাব দেব।’
দুদক কর্মকর্তারা মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন, অভিযোগের অনুলিপি আরজিনাকে দেওয়া হয়েছে। এখনও আরজিনাকে ডাকা হয়নি। অভিযোগটি এখনও নথিভুক্ত না হলেও দুদক কর্মকর্তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন