উপ-সম্পাদকীয়
শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানভীতি দূর করতে ড. আহাদের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী

প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের মাঝে ড.আহাদ
এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের গ্রামের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়তে চায়না। বিজ্ঞানে তাদের আগ্রহ কম। কিন্তু তাদেরকে যদি পদার্থ, রসায়ন,উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান বাড়ানো যায় তবে তা জাতীয় জীবনে অনেক কাজে লাগবে। পাশাপাশি তাদের প্রণিসম্পদ বিষয়ে সাধারন জ্ঞান দিতে পারলেও তা তারা নিজেদের বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারবে। আর এই জ্ঞান ধারণা দিতে হবে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক পর্যায় থেকে। কিন্তু কিভাবে তাদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলা যায়।
এই চিন্তা থেকে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে সহজ পাঠ্য করেছেন একজন শিক্ষাগুরু। তিনি সহজ করে নিজেস্ব জ্ঞান ধারণা দিয়ে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে তৈরি করেছেন। শিক্ষার্থীদের মাঝে তা প্রয়োগের জন্য তিনি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। ইতোমধ্যেই তিনি ১২৬ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশিক্ষিত করে তুলেছেন। তার পুরো কাজটাকে প্রশংসিত করেছেন দেশের বরেণ্য শিক্ষাগুরুরা। পদস্থ সরকারি শিক্ষা কর্মকর্তারা বিষয়টিকে ইতিবাচক এবং ব্যপক সম্ভাবনাময় বলে মতামত দিয়েছেন।
প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদেরকে জাতীয় শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী ৯ম ও ১০ম শ্রেনির পাঠ্য পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন এবং জীব বিজ্ঞান সমন্ধে পাঠদান করা হয়। এছাড়া ভেটেরিনারি সায়েন্স বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়া হয়।
বেশ কয়েক বছর পূর্বে ড. আহাদ প্রথম অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আমেরিকান একজন নাগরিক সালমান খানের মাধ্যমে। তার পূর্ব পুরুষ বাংলাদেশের নাগরিক। তিনি আমেরিকায় ২০০৮ সালে “খান একাডেমি” নামক একটি স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেন। এই একাডেমিটি একটি অলাভজনক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এবং এর মূলমন্ত্র ছিল “পৃথিবীর যেকোন স্থানে, যে কাউকে বিনা মূল্যে বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদান করা”। সত্যিকার অর্থে এই বাক্যটি ড.আহাদকে হৃদয়ে মর্মে স্পর্শ করে। তিনি তখন চিন্তা করা শুরু করলেন, সালমান খানের মতো আমাদের দেশের জন্য কিছু করার। প্রাথমিক ভাবে তিনি তার নিজ গ্রাম থেকে কাজটি শুরু করার জন্য চিন্তা করলেন।
তিনি ভাবলেন, কিভাবে তাঁর গ্রামের লোকজন কে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা যায়। এর প্রথম ধাপ হিসেবে, তিনি অনুভব করলেন গ্রামের মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকদের মাধ্যমে তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা এবং জনসাধারণের নিকট আগ্রহ সৃষ্টি করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করা।
ড.আহাদ চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রবায়োলজি ও ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তার ২২ বছরের চেয়েও বেশি শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি মনে করলেন, যদি স্কুল শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা যায় এবং ঐ প্রশিক্ষিত শিক্ষক তার চাকুরির ২০-৩০ বছরের মধ্যে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর সম্মুখীন হবেন। যার ফলে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের মাধ্যমে পরবর্তী কিছুটা সুবিধাবঞ্চিত গ্রামের স্কুল ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষা বিষয়ে উপকৃত হবে। তিনি সেই মোতাবেক কোন প্রকার সম্মানী ব্যাতিরকেই নবম – দশম শ্রেণির স্কুল শিক্ষকদের কে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করেন।
তিনি তার চিন্তা-ভাবনা আবু খালেদ মো. ছাইফ উল্লাহ কে অবহিত করেন। যিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অফিসে উপ-পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত। ড.আহাদ এবং আবু খালেদ মো. ছাইফ উল্লাহ একই এলাকাতে বসবাস করেন। যা বাংলাদেশের দক্ষিন প্রান্তের লক্ষীপুর জেলায় অবস্থিত। তার পক্ষে প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে এলাকার স্কুল শিক্ষকের যোগাযোগ সহজতর ছিল। কারণ, তিনি সেই এলাকার একজন সম্মানিত ব্যাক্তি এবং স্থায়ী বাসিন্দা। জনাব আবু খালেদ মো. ছাইফ উল্লাহ প্রশিক্ষানার্থী শিক্ষকদের উৎসাহের জন্য কিছু আর্থিক সম্মানীর ব্যবস্থা করতে বললেন। তা না হয় হয়তো এই প্রশিক্ষণ তেমন ফলপ্রসূ হবে না। ড.আহাদ এতে কিছুটা হতাশাগ্রস্থ হলেন। কারণ তার পক্ষে নিজের অর্থে প্রশিক্ষণ দেয়াটা দূষ্কর ছিল। কিন্তু তিনি তার স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দিলেন না। তিনি মনে করলেন একদিন হয়তো তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
তিনি তার এই চিন্তা ভাবনাটি তার কিছু সহকর্মী/বন্ধু/ আত্মীয়-স্বজন কে জানালেন। কিছু লোক তার ধারণাটিকে প্রশংসা করলেন এবং কেউ বললেন, এটি হয়তো সম্ভব হবে না। মনে হলো যেন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো অবস্থা। ড.আহাদকে ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের ২ বছরের মেয়াদের জন্য ডীনের দায়িত্বে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই সময় তিনি আন্তর্জাতিক ভেটেরিনারি মেডিকেল কাউন্সিল (আমেরিকান ভেটেরিনারি অঙ্গসংস্থার একটি প্রতিষ্ঠান) থেকে একটি প্রকল্পের আহবান পান। প্রকল্পের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল গ্রামে ভেটেরিনারি শিক্ষার প্রসার করা। লেখক এই সুযোগটিকে কাজে লাগালেন। তিনি তার চিন্তা ভাবনার সাথে ভেটেরিনারি শিক্ষা কে যোগ করে একটি প্রকল্প তৈরি করেন এবং যথাযথ কতৃপক্ষের নিকট দাখিল করেন। দূর্ভাগ্য বশত তার সেই প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়নি।
তিনি পুরো ঘটনাটি বিস্তারিত ভাবে তার এক শিক্ষাগুরু অধ্যাপক মোহাম্মদ শওকত আনোয়ারকে অবহিত করলেন। তিনি আমেরিকার TUFTS Cummings School of Veterinary Medicine বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী-ডিন হিসেবে কর্মরত। আমেরিকার অধ্যাপকের নিকট ঘটনাটি অত্যান্ত হৃদয়গ্রাহী হল। তিনি ড.আহাদকে আশ্বাস দিলেন যে একটি পাইলট প্রকল্পের পরিচালনা করার জন্য অনুদান সংগ্রহ করে দিবেন।
২০২০ সালে কোভিড-১৯ (SARS-CoV2) ভাইরাসজনিত বিশ্ব মহামারীর কারণে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগ দেশ আক্রান্ত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনেকদিন যাবত বন্ধ ছিলো। লকডাউনের কারণে জনসাধারণকে নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করতে বলা হয়েছিলো। ড.আহাদ এই সুযোগটিকে কাজে লাগালেন। এই অপ্রত্যাশিত ছুটির দিনে তিনি নবম-দশম শ্রেণীর জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং বোর্ডের অনুমোদিত জীববিজ্ঞান এবং রসায়ন বইটি ইংরেজী ভাষায় নতুনভাবে লিপিবদ্ধ করেন। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়টি তিনি আরেকজন ব্যক্তির উপর ন্যস্ত করেন। এই বই দুটিতে তিনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে ছাত্রদের নিকট বিষয়টি সহজভাবে বোধগোম্য করার জন্য ইন্টারনেট থেকে অনেক ছবি ডাউনলোড করেন।
তিনি আন্তরিকভাবে ঐ সমস্ত জনসাধারণের কাছে কৃতজ্ঞ, যারা তাদের বিষয়গুলো ইন্টারনেটে আপলোড করেছেন এবং ব্যবহারকারীদের জন্য সুযোগ করে দিয়েছেন। ড.আহাদ জীববিজ্ঞান বইটি ইংরেজীতে লিপিবদ্ধ করার পর তিনি তার শ্রদ্ধেয় বড় ভাইকে বইটিকে বাংলায় অনুবাদ করতে অনুরোধ করেন। তার বড়ভাই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগ-তত্ত্ব এবং বীজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত। এই বইটি দ্বারা নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা উপকৃত হবে, এবং স্কুলের শিক্ষকদের জন্যও পাঠদানে সহায়তা করবে।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে ড.আহাদের কর্মসূচী সর্ব মহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এখন প্রয়োজন সরকারের সহযোগিতা। প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের কাজে লাগিয়ে এই কর্মসূচী সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন, এই অভিমত দেশের শিক্ষানুরাগীদের।
উত্তরের কণ্ঠ/পিআর/এসআর
আপনার মতামত লিখুন