বেদনায় ভরা দিন

রোড ৩২, ধানমন্ডি
তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। দূরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এমন সময় প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ। এ গোলাগুলির আওয়াজ ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি ঘিরে, যে বাড়িতে বসবাস করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এক বিঘা জমির ওপর খুবই সাধারণ মানের ছোট্ট একটা বাড়ি। মধ্যবিত্ত মানুষের মতোই সেখানে বসবাস করেন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি সবসময়ই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। এই বাড়ি থেকেই ১৯৭১ সালের ২৬-এ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যে আন্দোলন-সংগ্রাম-এই বাড়িটি তার নীরব সাক্ষী। সেই বাড়িটিই হলো আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে আজানের ধ্বনি হারিয়ে যায়।
আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছিল দেশের মানুষের প্রতি অঢেল ভালোবাসা। তিনি সকলকেই অন্ধের মতো বিশ্বাস করতেন। তিনি কখনো এটা ভাবতেও পারেননি যে, কোনো বাঙালি তাঁর ওপর গুলি চালাতে পারে বা তাঁকে হত্যা করতে পারে। তাঁকে বাঙালি কখনো মারবে না, ক্ষতি করবে না—এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি চলতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সেই বিশ্বাসের কি মূল্য তিনি পেয়েছিলেন?
গৃহকর্মী আব্দুল গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তাকেও নিয়ে যায়। বাড়ির সামনে আম গাছতলায় সবাইকে দাঁড় করিয়ে একে একে পরিচয় জিজ্ঞেস করে। আমার একমাত্র চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের পঙ্গু ছিলেন। তিনি বারবার মিনতি করছিলেন—আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা; আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে মেরো না। ছোট ছোট বাচ্চারা আমার, ওদের কী হবে? কিন্তু খুনিরা কোনো কথাই কানে নেয় না। তাঁর পরিচয় পেয়ে তাঁকে অফিস ঘরের বাথরুমে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
রমার হাত ধরে রাসেল “মা’র কাছে যাব, মা’র কাছে যাব” বলে কান্নাকা করছিল। রমা বারবার ওকে বোঝাচ্ছিল—তুমি কেঁদো না ভাই। ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু অবুঝ শিশু মায়ের কাছে যাব বলে কেঁদেই চলছে। এ সময় একজন পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় পেয়ে বলে—চলো, তোমাকে মায়ের কাছে দিয়ে আসি।
ভাইয়ের লাশ, বাবার লাশ মাড়িয়ে রাসেলকে টানতে টানতে দোতলায় নিয়ে মায়ের লাশের পাশেই গুলি করে হত্যা করে। দশ বছরের ছোট্ট শিশুকে ঘাতকের দল বাঁচতে দিল না।
যে বাড়ি থেকে একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই বাড়িটি রক্তে ভেসে গেল। সেই রক্তের ধারা ওই সিঁড়ি বেয়ে বাংলার মাটিতে মিশে গেছে-যে মাটির মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন।
৪৬ ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন শাফায়াত জামিল। সেনাপ্রধান তাঁকে ফোন করে পায়নি। সিজিএস খালেদ মোশাররফও কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ জিয়াউর রহমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেনি বরং সে পুরো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।
খুনি রশিদ ও ফারুক বিবিসি-তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা বলেছে। খুনি মোস্তাক জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়। ঢাকার তৎকালীন এসপি মাহবুবকেও ফোন করে পাওয়া যায়নি।
মেজ ফুপুর বাসা
ঘাতকেরা ধানমন্ডির মেজ ফুফুর বাড়ি আক্রমণ করে রিসালদার মোসলেউদ্দিনের নেতৃত্বে। তাদের একটি দল সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে গালি দিতে থাকে। বুটের আওয়াজ আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে মুক্তিযোদ্ধা যুবনেতা এবং বাংলার বাণীর সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। বন্দুক তাক করে তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে ঘাতকের দল।
এ সময় তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু ছুটে এসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ঘাতকদের বুলেট থেকে বাঁচাতে। কিন্তু ঘাতকের দল তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করে। বুলেটের আঘাতে দুজনের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিথর দেহ দুটি। ছোট দুই ছেলে, তিন বছরের তাপস আর বছর পাঁচেকের পরশ, মা-বাবার লাশের পাশে এসে চিৎকার করতে থাকে আর বলতে থাকে—মা ওঠো, বাবা ওঠো। ঐ শিশুদের কান্না মা-বাবা কি শুনতে পেয়েছিল? ততক্ষণে তাঁরা তো না-ফেরার দেশে চলে গেছে। শিশুদের চোখের পানি মা-বাবার রক্তের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়।
সেজ ফুপুর বাড়ি
গুলি করতে করতে মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মেজর এ এম রাশেদ চৌধুরী মিন্টু রোডে সেজ ফুফার সরকারি বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে যায়। পরিবারের সব সদস্যকে তাঁদের ঘর থেকে বের করে নিচতলায় বসার ঘরে নিয়ে আসে। এরপর তাদের ওপর ব্রাশ ফায়ার করে।
গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়েন আমার ফুপু আমিনা সেরনিয়াবাত, আমার ফুফা কৃষিমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর মেয়ে বিউটি, বেবি, রিনা, ছেলে খোকন, আরিফ, বড় ছেলে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর স্ত্রী শাহানা, নাতি সুকান্ত, ভাইয়ের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ, ভাগ্নে রেন্টু।
আট বছরের নাতনি কান্তা গুলিবিদ্ধ লাশের নিচে চাপা পড়ে যাওয়ায় বেঁচে যায়। দেড় বছরের নাতি সাদেক গুলিবিদ্ধ মায়ের বুকে পড়ে কাঁদতে থাকে। আট বছরের কান্তা নিজের ফুফু বেবির লাশের নিচে চাপা পড়েছিল। সেখান থেকে কোনো মতে বের হয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
সোবহানবাগ
আব্বার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওনা হন। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাঁর গাড়ি আটকে দেয় ঘাতকেরা। তিনি এগোতে চাইলে ঘাতকেরা তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। আমাদের বাড়ির নিচে পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্য এসআই সিদ্দিকুর রহমানকেও তারা গুলি করে হত্যা করে।
বেলজিয়াম
ক্রিং ক্রিং ক্রিং …। টেলিফোনটা বেজেই যাচ্ছে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো টেলিফোনের আওয়াজ এত কর্কশ? আমি ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ালাম। দেখি নিচে অ্যাম্বাসেডর সানাউল হক সাহেব ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ওয়াজেদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমি তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম।
অপর পারে জার্মানির অ্যাম্বাসেডর হুমায়ুন রশিদ সাহেব কথা বলছেন। তিনি জানালেন বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। আমার মুখ থেকে বের হলো—‘তাহলে তো আমাদের আর কেউ বেঁচে নাই।’ রেহানা পাশে ছিল। তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু তখনো জানি না কী ঘটনা ঘটেছে।
মাত্র ১৫ দিন আগে জার্মানি এসেছি। বেলজিয়ামে বেড়াতে এসেছি। নেদারল্যান্ডেও গিয়েছিলাম। আব্বা বলেছিলেন—নেদারল্যান্ড কীভাবে সাগর থেকে ভূমি উত্তোলন করে-পারলে একবার দেখে এসো। একদিন আগেই আব্বা-মা’র সঙ্গে কথা হয়েছে। কেন জানি মা খুব কাঁদছিলেন। বললেন—‘তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে, তুই আসলে আমি বলবো।’ আমাদের খুব খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল তখনই দেশে ছুটে চলে যায়।
আব্বা বললেন—রোমানিয়া ও বুলগেরিয়াতে তিনি যাবেন। আর ফেরার পথে আমাদের নিয়ে আসবেন।
কিন্তু আমাদের আর দেশে ফেরা হলো না। একদিন পরই সব শেষ। বেলজিয়ামের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হক, যিনি রাজনৈতিক সদিচ্ছায় অ্যাম্বাসেডর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন, রাতারাতি তার চেহারাটাই পাল্টে গেল। তিনি জার্মানিতে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ সাহেবকে বলেন, যে বিপদ আমার কাঁধে পাঠিয়েছেন তাঁদের ফেরত নেন।
যিনি আগের রাতে আমাদের জন্য ‘ক্যান্ডেল লাইট ডিনার’ এর আয়োজন করেছিলেন; কত খাতির, আদর-যত্ন, আর এখন আমরা তার কাছে আপদ হয়ে গেলাম। আমাদের বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়িটাও দিলেন না। বেলজিয়াম অ্যাম্বাসিতে কর্মরত আমার স্কুলের বান্ধবী নমি’র স্বামী জাহাঙ্গীর সাদাতের গাড়িতে করে আমাদের বেলজিয়াম বর্ডারে যেতে বললেন।
উপসংহার
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত বেদনার আঘাত বুকে ধারণ করে আমার পথচলা। বাবা-মা-ভাইদের হারিয়ে ৬ বছর পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসতে পেরেছি। একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি, যে বাংলাদেশ আমার বাবা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, তা ব্যর্থ হতে পারে না। লাখো শহীদের রক্ত আর আমার বাবা-মা-ভাইদের রক্ত ব্যর্থ হতে আমি দেব না।
আমার চলার পথ খুব সহজ ছিল না, বারবার আমার ওপর আঘাত এসেছে। মিথ্যা অপপ্রচার, গুলি, বোমা ও গ্রেনেড হামলার শিকার হতে হয়েছে আমাকে। খুনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া বিভিন্ন সময় বলেছিল—‘শত বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না। শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধী দলের নেতাও কখনো হতে পারবে না।’
এরপরেই তো সেই ভয়াবহ ২০০৪ সালের ২১-এ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানবঢাল রচনা করে সেদিন আমাকে রক্ষা করেছিলেন। উপরে স্রষ্টা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আর বাংলাদেশের জনগণই আমার শক্তি। আমার চলার কণ্টকাকীর্ণ পথে এরাই আমাকে সাহায্য করে চলেছেন। তাই আজকের বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জনগণের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষুধার হাত থেকে মুক্তি দিতে পেরেছি। তারা এখন উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে।
বাবা! তুমি যেখানেই থাক না কেন, তোমার আশীর্বাদের হাত আমার মাথার ওপর আছে—আমি তা অনুভব করতে পারি। তোমার স্বপ্ন বাংলাদেশের জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যবস্থা করে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। তোমার দেশের মানুষ তোমার গভীর ভালোবাসা পেয়েছে আর এই ভালোবাসার শক্তিই হচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
শেখ হাসিনা ।। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা
আপনার মতামত লিখুন