উপ-সম্পাদকীয়
ভাঙনের শব্দ শুনি

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে নতুন নতুন অনেক চমক অপেক্ষা করছে। দিন পনেরোর মধ্যেই অনেক নাটকের শেষদৃশ্য দেখতে পাবো আমরা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে নানা ঘটনার। পর্দার আড়ালে থাকা কুশিলবরা বেরিয়ে আসছেন দৃশ্যপটে। বিএনপি যখন নির্বাচনে যাবেনা তাদের একদফার বাস্তবায়ন নাহলে, ঠিক তখনই শোনা যাচ্ছে দলে ভাঙনের শব্দ। তফসিল ঘোষণার দিনই বিএনপির বর্তমান ও সাবেক ১২৫ নেতার নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’ আসন্ন ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। তফসিল ঘোষণার দিন বিকেলে রাজধানীর মালিবাগ এলাকার স্কাই সিটি হোটেল লাউঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এ ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খন্দকার আহসান হাবিব। এর আগে তিনি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। তিনি টাঙ্গাইল-৫ আসন থেকে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার ঘোষণা দেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার এ কে এম ফখরুল ইসলাম, তিনি ঝালকাঠি-২ আসন থেকে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করবেন। হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ২০০১-০৪ মেয়াদের সাবেক ট্রাস্টি স্বপন সরকার, তিনি রাজবাড়ী-১ আসন থেকে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করবেন। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাবেক সহ-সভাপতি টাঙ্গাইল সাদত কলেজের সাবেক ভিপি মনিরুল ইসলাম মিন্টু, তিনি টাঙ্গাইল-৮ আসন থেকে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করবেন বলে জানান। লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি জানালেও পরবর্তীতে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আহসান হাবিব বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মুক্তির দাবি জানান।
এ ছাড়া বিএনপির অন্যতম নেতা হয়েও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ঘোষণা সংগঠনটির শৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো বিষয় আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপির গঠনতন্ত্রে এমন কোনো দিকনির্দেশনা আছে বলে আমার জানা নেই। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও কোনো নিবন্ধিত দল বা জোটের সঙ্গে তারা অংশীদার হবেন না বলেও জানিয়েছে ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’।
বিএনপির আরেক নেতা মেজর হাফিজকে নিয়ে চলছে আরেক ঘটনা। একটা দলে ভাঙনের আলামত দেখা দিলে মূল দল বলে, দলছুটদের কারণে মূল দলের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। যদি বিরোধী দল হয় তাহলে তারা আরও একটি কথা যোগ করে-সরকারের প্ররোচনায় দল ভাঙা হচ্ছে। দলছুটে আগ্রহীরা সরকারের দালাল এমন কথা বলতেও কসুর করে না মূল দলের পক্ষ থেকে। আর দলছুট নেতারা প্রথম অবস্থায় ধরি মাছ না ছুঁই পানির অবস্থানে থাকেন। এই মুহূর্তেও তাই দেখা যাচ্ছে। একটা সময় যখন নতুন নামে তারা আবির্ভূত হন, তখন সরাসরিই পূর্বদলের গোষ্ঠী উদ্ধার করেন- কখনো পরোক্ষ কখনো সরাসরি। এবার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর হাফিজ উদ্দীন বীর বিক্রম, মিডিয়ায় মুখ খুলেছেন। এখন তার অবস্থান পরোক্ষ। তার নড়েচড়ে বসার বিষয়টি কিন্তু ভাবার মতোও। তিনি বিএনপি ছাড়েননি। বিএনপিও তাকে ছাড়েনি। এমনকি তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন আছেন, তাও কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু এটা স্পষ্ট, মেজর হাফিজকে দলীয় কোনো কর্মসূচি এমনকি সিদ্ধান্ত গ্রহণেও অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। মেজর হাফিজ এর সা¤প্রতিক সাংবাদিক সম্মেলন এবং গণমাধ্যমে নানামুখী বিশ্লেষণ দেখে মনে হতে পারে, নতুন কিছু দেখার সম্ভাবনা দৃঢ় হচ্ছে। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিলো তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কি না? তিনি নতুন কোনো দল করছেন কি না। তিনি এর জবাবে বলেছেন ‘নো কমেন্ট’। রাজনীতিতে এই ‘নো কমেন্ট’ শব্দদ্বয় যে অধিকাংশক্ষেত্রেই ইতিবাচক কমেন্ট হয়ে থাকে তা সবার জানা। অর্থাৎ মেজর হাফিজের নেতৃত্বে নতুন দল হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসাটা ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আপনি নতুন দল করছেন, নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে সরকারের মন্ত্রীরা দাবি করছেন, এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? জবাবে মেজর হাফিজ বলেন,‘এই বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমি দেখছি এই টুকুই আপনি লিখুন। এর বেশি কিছু এখন বলব না।’ তাঁর এমন বক্তব্যও ইঙ্গিতবহ বলে মনে করছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
মেজর হাফিজ বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে যে উষ্মা প্রকাশ করেছেন সেই বিষয়টিও গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। পরিস্থিতি পরিবেশ বিশ্লেষণ করে এটা মনে করা যায়, আরেকটি বিএনপি হয়তো শিগগিরই আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। যেহেতু মেজর হাফিজকে এখনও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি, তাই তিনি যদি তড়িঘড়ি করে সাধারণ সভা ডেকে নতুন বিএনপির জন্ম দেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সেক্ষেত্রে বিএনপি নামে তিনি নির্বাচনে অংশ নিলেও আইনগতভাবে তা গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা । সেক্ষেত্রে তিনি হয় তো প্রথম সাধারণসভাতেই তারেক জিয়াসহ অন্যদের দল থেকে বহিষ্কার করার মধ্য দিয়ে যাত্রা করতে পারেন। এমন পরিস্থিতি হলে নতুন দলে বিএনপির প্রথম সারির অনেক নেতাকেই পাওয়া যাবে। বিশেষ করে যারা দলে এখন নিষ্কৃয় হয়ে আছেন, যাদের দল থেকে মূল্যায়ন করা হয় না,যারা তারেক রহমানের নেতৃত্বকে অপছন্দ করেও দলে টিকে আছেন, বিভিন্ন সময় দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন তারাও যে ওই দলে যোগ দিতে পারেন তা অনুমান করা যায়।
দলত্যাগীদের কারণে একটা দলের সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল হয়ে যায় । কত ত্যাগী নেতাকে বিএনপি ছাড়তে হয়েছে সেই হিসাবটা অবশ্যই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে আছে। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা তৃণমূল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে বিএনপির ছায়া রেখে দিয়েছেন। তার দলছুটের কারণে একসময়ের বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শমসের মোবিন চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারের দলীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বিএনপি। সেই তৃণমূল বিএনপি ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে আসছে। সেই তিনশ জনের মধ্যে বর্তমানের মূলধারার বিএনপির যদি ৫০ জন থাকেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা।
ভাঙনের শব্দ শুনি, একটি নাটকের নাম। রাজনীতির নাটকের শেষদৃশ্য দেখতে আমাদের আরো কটাদিন অপেক্ষা করতে হবে।
বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নানা রকমের অভিযোগ থাকা সত্তে¡ও সংসদ নির্বাচন করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। বর্তমান সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে ১২তম সংসদীয় নির্বাচন হতেই হবে। নির্বাচন বর্জন একটি দলের অধিকার হতে পারে না, তবে নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য আন্দোলনের ডাক দেওয়া অনৈতিক এবং সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করার শামিল।
উত্তরের কন্ঠ /এ,এস ,নয়ন
আপনার মতামত লিখুন