উপ-সম্পাদকীয়
দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে নতুন দার উন্মোচন

পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর-খুলনা ও বেনাপোল রুটে প্রাথমিকভাবে ৮ জোড়া ট্রেন চলবে। এসব ট্রেনের প্রতিদিন যাত্রী ধারণ ক্ষমতা হবে ১৪ হাজার ৫০০ জন। এছাড়া তিন জোড়া ওয়াগন ও কন্টেইনার চালানো হবে। এর মাধ্যমে ২৬৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করা সম্ভব হবে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ রয়েছে আগামী বছর জুন পর্যন্ত। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হবে। বাণিজ্যিকভাবে এই রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার পর ঢাকা-যশোর-বেনাপোল এবং ঢাকা-খুলনা-মোংলা পথে প্রাথমিকভাবে ৮ জোড়া যাত্রীবাহী আন্তঃনগর ট্রেন পরিচালনা করা হবে। এই পথে দিনে ১৪ হাজার ৫০০ জন যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে।
এ পথে যাত্রী পরিবহন করেই প্রতি বছর ২৬৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় সম্ভব হবে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এই পথে পণ্যবাহী ওয়াগন এবং কন্টেইনার মিলে তিন জোড়া ট্রেন চালানো হবে। মালামাল পরিবহন করে প্রতি বছর প্রায় ১০৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করা সম্ভব হবে। কেবল এ অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে না বরং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্রমবর্ধমান রাজস্ব আয়ের চিত্র তুলে ধরেন রেলপথ সচিব। তিনি বলেন, ২০২০-২১ সালে যেখানে বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজস্ব আয় হয় ১১৬৬ কোটি টাকা, সেখানে ২১-২২ সালে ১৪৬৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৭৮৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করছে। রেলওয়ে ক্রমান্বয়ে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে।
রেলপথ সচিব বলেন, ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচলে সক্ষম এই রেলপথে ঢাকা থেকে যশোরের দূরত্ব হ্রাস পাবে ১৮৪ কিলোমিটার এবং যাত্রায় সময় লাগবে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন ঘণ্টা। খুলনার দ্রুত হ্রাস পাবে ২১২ কিলোমিটার ও সময় লাগবে সর্বোচ্চ পৌনে চার ঘণ্টা। অথচ বর্তমানে ঢাকা থেকে খুলনা যেতে সময় লাগছে ৯-১০ ঘণ্টা। সুতরাং ঢাকা থেকে দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের জন্য যোগাযোগের নতুন দার উন্মোচন হবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা মানেই নতুন কিছু, মানুষের মনের কাছাকাছি নতুন কিছু একটা করা। তেমনই পদ্মাসেতুর ওপর রেল চলাচলের উদ্বোধনের সময় তিনি সহযাত্রী করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি রিকশাচালক, কৃষক, মাঝি, বাসচালক, সবজি বিক্রেতা, পাটকল শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৫০ জন যাত্রীকে।
প্রধানমন্ত্রীর এই সহযাত্রীদের মধ্যে ছিলেন চারজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, চারজন প্রাথমিকের শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দুইজন প্রতিনিধি, একজন করে প্রাথমিক শিক্ষক, মাদরাসা শিক্ষক, সনাতন ধর্মাবলম্বী, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী, একজন করে রিকশাচালক, নারী কৃষক, ফেরিচালক, মাঝি, মেট্রোরেল কন্ট্রোলার, টিটিই, ট্রেনচালক, স্টেশন মাস্টার, ওয়েম্যান, বাসচালক, হকার, সবজি বিক্রেতা এবং পাটকল শ্রমিক।
এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা পেশাজীবীদের প্রতিনিধিরাও সঙ্গে ছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন জেলা আনসার ও ভিডিপির একজন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, স্কাউট, বিএনসিসি, র্যাব, রেল পুলিশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও আরএনবির একজন করে প্রতিনিধি।
উত্তাল পদ্মার ওপর রেলযাত্রায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাত্রী হতে পেরে তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার সঙ্গে ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার আনন্দ ছিল তাদের চোখে-মুখে। তারা বলছিলেন, সবাইকে সমানভাবে দেখার যে মহত্ব প্রধানমন্ত্রী দেখিয়েছেন সেটা অনবদ্য। সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করায় ও মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার এক অনন্য ক্ষমতা আছে প্রধানমন্ত্রীর, সেটাই তিনি বারবার দেখিয়ে চলেছেন।
পদ্মার ওপর দিয়ে সড়ক যোগাযোগ চালুর ১৫ মাসের ব্যবধানে চালু হলো ট্রেন চলাচল। পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে আয়োজিত সুধী সমাবেশে উপস্থিত হয়ে রেল সংযোগ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের মানুষ প্রথমবারের মতো রেল যোগাযোগের আওতায় আসছে।
১ নভেম্বর থেকে ঢাকা-খুলনা পর্যন্ত চলাচলকারী সুন্দরবন এক্সপ্রেস, ঢাকা থেকে যশোরের বেনাপোল পর্যন্ত চলাচলকারী বেনাপোল এক্সপ্রেসের রুট পাল্টে চলবে পদ্মা সেতু হয়ে। পাশাপাশি রাজশাহী থেকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পর্যন্ত চলাচলকারী মধুমতি এক্সপ্রেস ট্রেনটির যাত্রাপথ বাড়বে। সেদিন থেকে এই ট্রেনটি চলবে রাজশাহী থেকে ঢাকা পর্যন্ত। এই রুট তিনটি চালুর পর মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হবে। এছাড়া ভাঙ্গা-পাচুরিয়া- রাজবাড়ী সেকশনও পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হবে।
যোগাযোগে পিছিয়ে পড়া দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের ২১ জেলার সাধারণ মানুষ ভোগান্তিবিহীন আর স্বল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে। এসব অঞ্চলে উৎপাদিত চিংড়ি, কাঁচামাল, সবজিসহ অন্যান্য পণ্য সহজে পরিবহনযোগে পাঠাচ্ছে রাজধানীর বুকে। এতে কৃষক লাভবানের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হচ্ছে। নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য তৈরি হওয়ায় কর্মসংস্থান বাড়ছে। পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচলের মধ্য দিয়ে নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে যাচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য। প্রথম পর্যায়ে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেলপথ চালু হবে। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত প্রায় ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণ করেছে। বলা হয়েছে, এ পথের বাকি অংশ আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে চালু করা হবে। ফলে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণ জনপদে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ে এক অনন্য যুগে প্রবেশ করবে। কিছুদিন আগে রেলওয়ের উন্নয়ন খাতে অগ্রগতির জন্য যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা চেয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার। যা রেলপথের সার্বিক অগ্রগতিতে আরো সহায়ক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে খুলনা থেকে ঢাকায় ট্রেন লাইনের দূরত্ব ৪৪৯ কিলোমিটার। কিন্তু পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা-খুলনার দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার। আর ঢাকা-যশোরের দূরত্ব কমবে ১৮৪ কিলোমিটার। ফলে একদিকে যেমন যাত্রীদের সময় বাঁচবে অন্যদিকে জ্বালানিও সাশ্রয়ী হবে রেলওয়ের। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত এই রেলপথে ২০টি রেলস্টেশন থাকবে।
পদ্মা সেতুর সড়কপথ চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যাত্রবাহী ট্রেন লাইন চালুর পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যিক (মালবাহী) ট্রেন চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য স্বল্প খরচে কৃষকরা ঢাকায় তুলতে পারবে। যা এ অঞ্চলের সার্বিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পটি ‘পদ্মা রেল সংযোগ’ প্রকল্প নামে পরিচিত।
এ প্রকল্পের আওতায় ১০০টি আধুনিক ব্রডগেজ প্যাসেঞ্জার ক্যারেজ কেনা হয়েছে। যাতে রেলপথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি যাত্রীরা ভোগান্তিবিহীন দ্রুত সময়ে যাতায়াত করতে পারে। তবে প্রতি বছর রেল খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। নতুন নতুন পথ তৈরি হচ্ছে; সংযুক্ত হচ্ছে আধুনিক বিলাসবহুল কোচ। কিন্তু ভোগান্তি আর যাত্রীদের কাঙ্খিত সেবার মান বাড়ছে না। আয়ের থেকে ব্যয় ক্রমাগত হারে বাড়ছে। বছরের পর বছর রেল লোকসান দিয়ে চলছে।
রেল মন্ত্রণালয় কিংবা রেল কর্তৃপক্ষ যাত্রী আর মালের ভাড়া কম থাকায় লোকসান হচ্ছে বলে এড়িয়ে গেলেও এর পেছনে রয়েছে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অসৎ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি আর রেল পুলিশের অবৈধ কার্যক্রম। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। নতুন এই প্রকল্পে যাতে দুর্নীতি না হয় এবং লাভবান হওয়া যায় তার জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে বর্তমানের এ অবস্থা থেকে কোনোভাবেই রেল খাতে উন্নতি সম্ভব নয়। পাশাপাশি পদ্মা রেল সংযোগ এই প্রকল্পে যাত্রীবাহী ট্রেনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ট্রেন চালু করার দিকেও কর্তৃপক্ষ সুনজর দেবে- এমনটাই প্রত্যাশা রইল। সরকার আন্তরিক হলে দেশ আরো উন্নতির দিকে যাবে, গণমানুষের এই বিশ্বাস এখন দৃঢ় হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক।
আপনার মতামত লিখুন