উপ-সম্পাদকীয়
দুইদলের একদফা বনাম মার্কিনীদের পাঁচ সুপারিশ
১৯৯৬ সালেন ১৫ ফেব্রুয়ারি এক তরফা নির্বাচন করেছিল বিএনপি। নির্বাচন বর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ। তবে মাঠে অসহযোগ আন্দোলন করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেছিল আওয়ামী লীগ এবং নির্বাচনে জয়ীও হয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি বিএনপি যদিও বাংলাদেশে সেই সময়টায় যে সহিংস আন্দোলন হয়েছিল এমনটা আর কোনো কালে অতীতে দেখা যায়নি।
এক তরফা নির্বাচন করে, দেড়শরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের নিয়ে পুরো মেয়াদ শেষ করে আবার ২০১৮ সালে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ। বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৭ টি আসন পায় মাত্র।
গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে কোনো জোরালো আন্দলোন গড়ে তুলতে পারেনি বিরোধীদলগুলো। নির্বাচন নিকটে, সময় খুবই কম। বিএনপির এবারের কৌশল ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করার মতো কর্মসূচির কথা ভাবছে দলটি। ভাবনায় এটিও আছে মার্কিন ভিসানীতির কারণে মাঠে বেশি কঠোর হতে পারবে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন। দল হিসেবেও আওয়ামী লীগ মারমুখী হতে পারবে না। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত বিএনপির কর্মসূচির ফলাফল কি দাঁড়ায়।
টানা ১৫ বছরের শাসকদলের বিরুদ্ধে ভোটাধিকার, মানবাধিকার, দুর্নীতি, অর্থপাচারসহ অনেক সমালোচনা আছে। কিন্তু এটা মানতেই হবে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার দেশে অভাবনীয় সব উন্নয়ন করেছে। বারবার ইতিহাস লেখা হচ্ছে নতুন করে। প্রথম মেয়াদেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের করে এনেছে সরকার।
দেশে এখন দুর্গম বলে আর কোনো এলাকা নেই। সড়ক, রেল, সেতুতে সংযুক্ত গোটাদেশ। নিজেদের অর্থে বানানো পদ্মা সেতু তো এখন আমাদের গৌরবের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে স্যাটেলাইট যুগে, সাবমেরিন যুগে, মেট্রোরেল যুগে, এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে যুগে, পারমাণবিক শক্তির যুগে, প্রবেশ করতে যাচ্ছে টানেল যুগে। এা ধারাবাহিকতায় অক্টোবরকে বলা যায় উন্নয়নের মাস।
গত ৫ অক্টোবর হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠান। যে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও। তার দুদিন পরেই শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আধুনিক তৃতীয় টার্মিনাল। এখন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলবে রেল। ২৯ অক্টোবর মেট্রোরেল চলবে মতিঝিল পর্যন্ত। এতদিন উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চললেও মতিঝিল পর্যন্ত এটি সম্প্রসারিত হলে এর সুফল পাবে আরো অনেক বেশি মানুষ। আগামী ২৮ অক্টোবর থেকে কর্ণফুলি নদীর নিচ দিয়ে চলবে গাড়ি। ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন এ মাসেই চলার কথা থাকলেও বন্যার কারণে তা হয়তো কিছুটা পিছিয়ে যাবে। তবে খুব বেশি যে পেছাবে না, তা বলাই যায়। ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আংশিক চালু হয়েছে। পুরোটা চালু হলে যানজট নিরসনে তা দারুণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন অন্য মাত্রায় উন্নীত হয়েছে।
এখন নভেম্বরকে ঘিরেই আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি করছে বিএনপি। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর জায়গা থেকে দেখলে আর সময়ও নেই তাদের হাতে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন প্রশ্নে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছুতে সরকারকে বাধ্য করতে সব করতে চায় তারা। সহজেই বোঝা যাচ্ছে জানুয়ারিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে নভেম্বর ডিসেম্বর এক সংঘাতময় পরিস্থিতিতে যাচ্ছে দেশ। বিএনপি আর আওয়ামীলীগ দুইদলই এখন একদফার ওপরে আছে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে একটি লিটমাস টেস্ট বলে অভিহিত করেছে সদ্য বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। পাঁচ দিনের সফর শেষে দেশে ফিরে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে তারা। এতে বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে পাঁচটি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পরামর্শে সংলাপ এবং মধ্যপন্থা অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
পর্যবেক্ষক দলের সদস্য ও এনডিআই কো চেয়ার কার্ল এফ. ইন্ডারফুর্থ বিবৃতিতে বলেন, আমরা মনে করি, প্রাথমিক সমস্যা হলো প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে গঠনমূলক অংশগ্রহণের অভাব। অচলাবস্থার অবসান ঘটানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ভালো বিশ্বাসের সংলাপ।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দৃঢ় ঐতিহ্য দেশটিকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার ২০৪১ সালের রূপকল্প অর্জনের জন্য শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ মানসম্পন্ন নির্বাচনের জন্য বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। যার মধ্যে রয়েছে আপসহীনতা, শূন্য-সমষ্টির (জিরো সাম) রাজনীতি, কঠোর বক্তব্য, রাজনৈতিক সহিংসতা, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি। এছাড়া নাগরিক, রাজনৈতিক নেতা এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে রয়েছে। আসন্ন নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি দেশটির অঙ্গীকারের জন্য একটি লিটমাস টেস্ট। প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে পারে এমন একটি রোডম্যাপ হিসেবে পাঁচটি পরামর্শ দিয়েছে।
প্রথম পরামর্শে সংলাপের আহ্বান করা হয়েছে। মধ্যপন্থি বক্তৃতা এবং প্রধান নির্বাচনি ইস্যুতে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে। দ্বিতীয় পরামর্শে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা এবং সব নাগরিকের ভিন্ন মতকে সম্মান জানাতে বলা হয়েছে। তৃতীয় পরামর্শে, অহিংসার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক সহিংসতার অপরাধীদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। চতুর্থ পরামর্শে, সব দলকে অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সর্বশেষ, নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সক্রিয় নির্বাচনি অংশগ্রহণের সংস্কৃতি প্রচার করার কথা বলা হয়েছে।
চলতি মাসের ৮ থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা সফর করে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) একটি যৌথ প্রতিনিধিদল। এসময় তারা নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে। তারা দেশে ফিরে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে।
কোনো শর্ত না দিলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি চিন্তা করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রোববার (১৫ অক্টোবর) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় তিনি এ কথা জানান। মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষণ দলের সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপসহ পাঁচটি সুপারিশের বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সংলাপের চিন্তা করবো তখন যখন তারা (বিএনপি) চারটি শর্ত প্রত্যাহার করে নেবে। শর্তযুক্ত সংলাপের ব্যাপারে আমাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। শর্ত তারা প্রত্যাহার করলে দেখা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘অন্য বিষয় (মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের) নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। ওগুলো নিয়ে আমরা সবাই একমত।’
শর্তমুক্তভাবে বিএনপি সংলাপ করতে চাইলে আওয়ামী লীগ সংলাপে বসবে কি না, এ প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তখন চিন্তা করে দেখবো।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘তারা (মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল) তো আমাদের সঙ্গে কথা বলে গেলো। বিশদ আলোচনা হয়েছে, নির্বাচন সম্পর্কিত যেসব বিষয় আছে সেগুলো বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার করা- সে অবস্থানে আমরা আছি এবং আমরা সেটি বলেছি।’
পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে সংলাপ নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট আলোচনা হয়নি দাবি করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সংলাপ নিয়ে স্পেসিফিক কোনো আলোচনা তারা করেনি। এখন যদি তারা মনে করেন এটা তাদের ব্যাপার, তারা বলতে পারেন। সংলাপ তো একপক্ষ করবে না। বিএনপি বলছে তারা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়, সংসদ ভেঙে দেওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ চায়। আমরা তো এই শর্তযুক্ত সংলাপে রাজি হবো না।’ সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তারা কার সঙ্গে আলোচনা করবেন? রাষ্ট্রপতি আলোচনা করতে চেয়েছেন- তারা (বিএনপি) রিজেক্ট করেছেন। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দুবার আলোচনার প্রস্তাব তারা খারিজ করে দিয়েছে।’
এখন বিএনপি তাদের নেতা লন্ডন থেকে কি বার্তা পাঠাবে সেই অপেক্ষায় আছে। ঢাকার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন,বিএনপি সংলাপে বসবে এবং নির্বাচনেও আসবে। তাদের ভেতরে ভেতরে সেই প্রস্তুতি চলছে। শর্ত যা থাকবে তা একান্ত গোপনে। তবে সবটুকু দেখার জন্য নভেম্বর মাসটা গুরুত্বপূর্ণ সময়।
লেখক : সাংবাদিক।
আপনার মতামত লিখুন